১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১: বাংলাদেশ ও ভারতের বিজয় দিবস এবং আমাদের বিভ্রান্তি।

মাহিন মাহবুব উল্লাহ্
0

১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবস। প্রতি বছর এই দিনটি এলেই ইতিহাস নিয়ে নানা সরলীকরণ চোখে পড়ে। আবেগের জায়গা থেকে আমরা ইতিহাসকে প্রায়শই একমাত্রিকভাবে ব্যাখ্যা করি। কিন্তু ১৯৭১ সালের সমর ইতিহাস ও ভূ-রাজনীতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সেখানে একটি নয়, বরং দুটি পৃথক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল এবং উভয় যুদ্ধেই পাকিস্তান পরাজিত হয়েছিল। এই সূক্ষ্ম পার্থক্যটি বোঝা ইতিহাসচর্চার জন্য অত্যন্ত জরুরি।



প্রথম যুদ্ধের সূচনা হয় ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে। এটি ছিল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সংঘটিত একটি অসম যুদ্ধ। একদিকে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তান সেনাবাহিনী, অন্যদিকে সাধারণ বাঙালি ও অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা। দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধই বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল ভিত্তি। ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগ আর মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে এই জনযুদ্ধ পাকিস্তানকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দিয়েছিল।


দ্বিতীয় যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি হয় ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১। পাকিস্তান বিমানবাহিনী ভারতের অমৃতসর, পাঠানকোট, শ্রীনগরসহ ১১টি বিমানঘাঁটিতে আকস্মিক প্রি-এম্পটিভ স্ট্রাইক (Pre-emptive strike) চালায়, যার কোডনেম ছিল ‘অপারেশন চেঙ্গিস খান’ (সূত্র: 1971: A Global History – Srinath Raghavan)। এর ফলেই ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই যুদ্ধ চলে মাত্র ১৩ দিন। ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, এই স্বল্প সময়ে ভারতের ৩,৮৪৩ জন সৈন্য নিহত এবং প্রায় ১০ হাজার সৈন্য আহত হন। ভারতের জন্য এটি ছিল একটি প্রথাগত সামরিক যুদ্ধজয়।


অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে, ১৬ ডিসেম্বর কেন পাকিস্তান সেনাবাহিনী মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করল, শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে নয় কেন? এর উত্তরটি নিছক আবেগের নয়, বরং কঠোর আইনি বাস্তবতার।


তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক মালিক তাঁর ‘Witness to Surrender’ বইতে উল্লেখ করেছেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করাটা ছিল একটি ‘Safe Bet’ বা নিরাপদ বাজি। কারণ:

 * মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন অনিয়মিত গেরিলা বাহিনী। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভয় পাচ্ছিল, মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়লে তাদের ওপর ৯ মাসের গণহত্যার প্রতিশোধ নেওয়া হতে পারে এবং জেনেভা কনভেনশনের পূর্ণ সুরক্ষা তারা নাও পেতে পারে।

 * অন্যদিকে, ভারত একটি নিয়মিত সেনাবাহিনী এবং জেনেভা কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ। তাই যুদ্ধবন্দি (POW) হিসেবে আইনি ও শারীরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই জেনারেল নিয়াজি যৌথ কমান্ডের প্রধান লেফট্যানেন্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা’র কাছে আত্মসমর্পণ করার সিদ্ধান্ত নেন (সূত্র: The Betrayal of East Pakistan – Lt. Gen. A.A.K. Niazi)।


অনেকে ভারতের অবদানকে বড় করে দেখতে গিয়ে বাংলাদেশের অবদানকে খাটো করেন, আবার অনেকে ভারতের রক্তদানকে অস্বীকার করেন। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বরের ‘Instrument of Surrender’ বা আত্মসমর্পণের দলিলে ইতিহাসের ভারসাম্য রক্ষা করা হয়েছে। দলিলের ভাষায় স্পষ্ট লেখা ছিল:


...surrender all Pakistan Armed Forces in Bangla Desh to Lieutenant-General Jagjit Singh Aurora, General Officer Commanding in Chief of Indian and Bangladesh Forces in the Eastern Theatre.


এখানে "Indian and Bangladesh Forces" উল্লেখ থাকার অর্থই হলো, এই বিজয় এককভাবে কোনো দেশের নয়, এটি ছিল যৌথ কমান্ডের চূড়ান্ত সাফল্য।


১৯৭১-এর ইতিহাস আমাদের আবেগের যেমন, তেমনি বুদ্ধিবৃত্তিক দায়িত্বেরও বিষয়। ১৬ ডিসেম্বর ভারতের জন্য একটি সামরিক বিজয় দিবস হতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশের জন্য এটি অস্তিত্বের মুক্তি। ভারতের প্রত্যক্ষ সামরিক হস্তক্ষেপ হয়তো যুদ্ধের সময় কমিয়ে এনেছিল, কিন্তু ৯ মাসের জনযুদ্ধই ছিল এই বিজয়ের প্রাণভোমরা।


ইতিহাসকে খণ্ডিতভাবে না দেখে তথ্য ও দলিলের আলোকে পূর্ণাঙ্গভাবে জানাই হোক এবারের বিজয় দিবসের অঙ্গীকার।

  • নবীনতর

    ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১: বাংলাদেশ ও ভারতের বিজয় দিবস এবং আমাদের বিভ্রান্তি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
3/related/default